শাসন রক্ষিত ভান্তের দেশনা:

উপাসক উপাসিকগণ, যে মা তার বুকের দুগ্ধ পান করিয়ে সন্তানকে পালন করেছেন, যে বাবা রোদে পুড়ে ঝড়ে ভিজে কঠোর পরিশ্রম করে আহার যুগিয়ে সন্তানকে মানুষ করেছেন, সেই সন্তানের কাছে মা-বাবার চেয়ে অন্য কোন কিছুই বড় হতে পারে না। আজ তাদের কারণেই আমরা নিজেকে পুণ্যময় কাৰ্য্যের মধ্য দিয়ে মানব জীবনকে সার্থক করে তোলার সুযোগ লাভ করেছি, সেই জীবনের জন্য হলেও আমরা মা-বাবার কাছে ঋণী । মা-বাবা ধনী হোক কিংবা গরীব হোক, শিক্ষিত হোক কিংবা অশিক্ষিত হোক, জ্ঞানী হোক কিংবা অজ্ঞানী হোক, যেই হোক না কেন তাদের স্নেহ, করুণার দানকে অস্বীকার করার সাধ্য কোন সন্তানের নেই। যে ভালোবাসা, স্নেহ, মায়া, মমতা দিয়ে মা-বাবা আমাদেরকে লালন-পালন করেছেন, হাজার হাজার টাকা ব্যয় কলে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষের মত মানুষ করেছেন তা বর্ণনাতীত ও অতুলনীয়। বলতে গেলে মা-বাবার কৃত উপকারের ঋণ অপরিশোধ্য। মা-বাবার সেই কৃত উপকার স্মরণ করে তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকা মানবীয়তার মহৎ গুণ।

মা-বাবাই হলেন সন্তানের কাছে দেবোত্তম ব্ৰহ্মাস্বরূপ। এক সময় ভগবান বুদ্ধ বলেছিলেন—“তোমরা সাক্ষাৎ ব্ৰহ্মাকে দেখতে ইচ্ছা কর কি? যদি সাক্ষাৎ ব্ৰহ্মাকে দেখতে চাও তাহলে তোমরা সাক্ষাৎ মা-বাবাকে দেখ।” কারণ মা-বাবা সন্তানের প্রতি ব্ৰহ্মবিহারী হয়ে জীবন যাপন করেন। ব্ৰহ্মবিহারী বলতে বুঝায়—যারা মৈত্রী, করুণা, মুদিতা ও উপেক্ষা এই চারিগুণের অনুশীলন করেন। মা-বাবাগণ সন্তানদেরকে সর্বদাই সর্বক্ষেত্রে অকৃত্রিমভাবে ভালোবাসেন। তাদের ভালোবাসা ও মায়া-মমতার কোন তুলনা নেই। পশু-পাখি জীব জন্তুর বাচ্চারা জন্মলগ্ন থেকে কিংবা জন্মের অল্পকাল পর হতেই আতনির্ভরশীল হয়ে উঠে। কিন্তু মানব শিশু আত্মনির্ভরশীল হতে সময় লাগে অনেক বছর । এ সময় মা-বাবাই হয় তার একমাত্র ভরসা । তারা আদরে-সোহাগে, স্নেহ-মমতা দিয়ে ধীরে ধীরে সন্তানকে বড় করে তোলেন। সন্তানের সুখ-সাচ্ছন্দ্যের জন্য তারা নিজেদের সুখ-সাচ্ছন্দ্যকে বিসর্জন দিয়ে উপরন্তু সন্তানদের সুখ-শান্তি কামনা করেন। সন্তানের প্রতি মা-বাবার এই অকৃত্রিম ভালোবাসাই হলো মৈত্রগুণ।

সন্তানের জন্য মা-বাবার চেয়ে বেশি আপন ও মঙ্গলাকাঙ্খী জগতে আর কেউ হতে পারে না । মা-বাবাই সন্তানদের মঙ্গল কামনা করেন। সন্তানের কোন দুঃখ-বেদনা, কিংবা, অমঙ্গল কোন মা-বাবাই কামনা করেন না। তাদের অভাব-অনটন, দুঃখ-কষ্ট, রোগ-ব্যাধি ইত্যাদি হতে দেখলে মা-বাবাগণ অতীব দুঃখিত হন। সন্তানের দুঃখের জন্য মা-বাবার যে আবেগ-উৎকণ্ঠা পৃথিবীতে বিরল। সন্তানের সুখ-শান্তির জন্য তারা নিজেদের জীবন বলি দিতে রাজী থাকেন এবং তাদের দুঃখ-দুৰ্দশা থেকে কিভাবে মুক্ত করা যায় সেই কামনা ও প্রচেষ্টায় থাকেন। সন্তানের দুঃখে দুঃখিত হয়ে তাদের দুঃখ-মুক্তির জন্য তাদের অন্তরে যে করুণা জাগ্রত হয় যা অতুলনীয়। ইহা সন্তানের প্রতি মা-বাবার করুণাগুণ ।

বলতে গেলে মা-বাবার সমস্ত জীবনই সন্তানের জন্য উৎসর্গীত। তাই তারা বহু কষ্টে উপার্জিত অৰ্থ-সম্পদ সন্তানের ভরণ পোষণার্থে ব্যয় করেন। সন্তানের ভবিষ্যৎ চিন্তায় মা-বাবার দু’চোখের ঘুম নষ্ট হয়ে যায়। সন্তান যখন লেখা-পড়ায় ভাল করে জীবনে সফল হয় এবং তাদের নাম-যশ কীর্তি চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে, তা দেখে মা-বাবারা অত্যন্ত আনন্দিত হন। সন্তানের এই সাফল্য উন্নতি ও সুখ-সমৃদ্ধি দর্শনে জগতের মানুষেরা হিংসায় জ্বলে পুড়ে মরলেও মা-বাবা আনন্দিত ও পরিতৃপ্ত হন। ইহা সন্তানের প্রতি মা-বাবার মুদিতাগুণ।

মা-বাবার যদি একাধিক সন্তান থাকে, তন্মধ্যে সুস্থ-সবল, সুদৰ্শন জ্ঞানী সন্তানকে যেমন ভালোবাসেন তেমনি ভালোবাসেন রোগী-পঙ্গু, জ্ঞানহীন অন্ধ সন্তানকেও। তারা সকল সন্তানকে সমানভাবে ভালোবাসেন এবং সকল সন্তানের মঙ্গল কামনা করেন। সন্তানেরা যদি মা-বাবার প্রতি অন্যায় অপরাধ করে থাকে, তাঁরা ইহা সন্তানের অজ্ঞানতা বলে উপেক্ষা করে থাকেন। অর্থাৎ সন্তানের দোষ-ত্রুটি মা-বাবারা ক্ষমা করে থাকেন। ইহা সন্তানের প্রতি মা-বাবার উপেক্ষাগুণ । স্বীয় সন্তানের প্রতি মা-বাবা এই চারিটি গুণের অনুশীলনকারী বলে ভগবান বুদ্ধ মা-বাবাকে সাক্ষাৎ ব্রহ্মারর সাথে তুলনা করেছেন। তাই যে সন্তান সেবা পূজা শ্রদ্ধা-ভক্তি ইত্যাদি আচরণে মা-বাবাকে সন্তুষ্ট করে দেবতারাও তার প্রতি সম্ভষ্ট হন। তিনি দেবগণের প্রিয় হন বলে আপদে-বিপদেও দেবগণ তার সহায় হন । অপরদিকে যে সন্তানের প্রতি মা-বাবা রুষ্ট হন দেবগণও তাদের প্রতি রুষ্ট হন। সেজন্য তার পদে পদে বিপদ অবশ্যম্ভাবী । তিনি জীবনেও সাফল্য লাভ করতে পারে না।

[সংকলনে : শ্রীমৎ অজিত কীর্তি ভিক্ষু]

তথ্যসুত্র ঃ ধর্ম টেক্সট

 

error: Content is protected !!