গুরুভন্তের দেশনাঃ অকালমৃত্যু কাদের হয় না/কারা দীর্ঘায়ু হয়???
বুদ্ধ ধাতু জাদী, পুল পাড়া, বান্দরবান। ০৪/০১/২০১৯ইং
মহাধর্মপালা জাতক থেকে
সংসার সমুদ্রে সবই অনিত্য। অনেকে ছোটকালেই অবুঝ বয়সে মারা যান, কেউবা মধ্য বয়সে। শুধু তাই নয় পৃথিবীর আলো না দেখে মায়ের পেটেই মৃত্যু ঘটে অনেকের। অল্পায়ু হলে নিজে যেমন পুণ্যকর্ম করতে পারে না, পরিবারেও কাজে আসে না, পরিবারের সদস্যদের সীমাহীন দুঃখ-কষ্টও সহ্য করতে হয়।
ধর্মচারী ব্যক্তি ধর্মপাল। ধর্মপাল বোধিসত্ব হয়ে জন্ম নেন। তাঁর নামেই গ্রাম। তাঁর পিতার নাম মহাধর্মপাল। ধর্মপালের পুরো বংশ অর্থাৎ পরিবার-আত্মীয় পরিজন সকলেই ১০ প্রকার কুশল কর্মে সর্বদা নিয়োজিত এবং ১০ প্রকার অকুশল কর্ম থেকে বিরত ছিলেন।
একসময় ধর্মপাল ১৬ বছর বয়সে তক্ষশীলায় বিদ্যাশিক্ষা নিতে যান। অল্প সময়ে তিনি যত রকমের বেদ-বিদ্যা ছিল সবই আয়ত্ত করেন। একদিন ধর্মপালের গুরু অর্থাৎ আচার্যের বড় ছেলে কম বয়সে মারা যান। তিনি ধর্মপালেরই সহপাঠী ছিলেন। মরদেহ শ্মশানে নেয়ার সময় সবাই কান্না করছিল। কিন্তু ধর্মপাল কান্না না করে ধীর-গম্ভীরভাবে স্বাভাবিক হয়ে ছিলেন। তাঁর এই স্বাভাবিক নির্লিপ্ত আচরণে সবাই অবাক হল। তাঁর এই নির্বিকারের কারন জানতে চাইলে তখন তিনি বলেন, আমাদের বন্ধু-সহপাঠী অকালে মারা গেছেন। এতে দুঃখ পাওয়ার কিছু নেই। তারা বললেন, সংসারে সবই অনিত্য তা ঠিক আছে, তাই বলে এত অল্প বয়সে একজন জ্ঞানী-গুণী মারা গেছে তোমার দুঃখ লাগছে না!!!
তখন ধর্মপাল বলেন, এত অল্প বয়সে আমাদের পরিবারে, বংশে কেউ মরে নি। সবাই বৃদ্ধ বয়সে মারা গেছে। একথা শুনে ধর্মপালের গুরু ঠিক করলেন তিনি ধর্মপালের গ্রামে যাবেন। গিয়ে দেখবেন এর কারণ কী। তবে যাওয়ার সময় আচার্য মৃত ছাগলের হাড়গোড় নিয়ে চললেন।
বাড়িতে গেলে ধর্মপালের পিতা মহাধর্মপাল ও তাঁর লোকজন অত্যন্ত শ্রদ্ধারর সাথে ভেতরে নিয়ে আগন্তুকের সেবা যত্ন করলেন। আচার্য নিজের পরিচয় দিয়ে বললেন, আপনার ছেলে ধর্মপাল মারা গেছে। সেকথা শোনার সাথে সাথে মহাধর্মপাল হা হা হা করে অট্টহাসি হাসলেন। আচার্য অবাক হলেন। তিনি সাথে নিয়ে আসা হাড়গোড় দেখিয়ে বললেন এই হাড়গোড় ধর্মপালের দেখুন। তবুও মহাধর্মপাল কিছুতেই বিশ্বাস করলেন না। বরং বললেন আমাদের বংশে ১০০ বয়স না হয়ে কেউ মরেনি। তাই আমি বিশ্বাস করিনা যে আমার ছেলে মারা গেছে। আচার্য বললেন, হ্যা মহাধর্মপাল আমি মিথ্যা বলেছি আপনাকে। আপনার ছেলে মরেনি। তাহলে আপনি আমাকে বলুন কীভাবে আপনারা দীর্ঘায়ু জীবন লাভ করে থাকেন।
তখন মহাধর্মপাল বললেন, আমরা, আমাদের বংশের সবাই সবসময় দানকর্ম, শীল পালন করে থাকি। সদাসর্বদা মিথ্যা বলা থেকে, সকল প্রকার অকুশলকর্ম থেকে, খারাপ আচরণ করা থেকে বিরত থাকি।
আমরা বাল-মূর্খদের সংস্পর্শে যাই না, তাদের সাথে কথাও বলি না। তারা যদি কিছু বলেও আমরা শুনি না, প্রতিপালন করি না। আমরা সাধু-সজ্জন, ধার্মিক, গুণী, শীলবান, পুণ্যবান, সৎপন্ডিতের সংস্পর্শে থাকি, সান্নিধ্যে থাকি, তাদের কথামত চলি, সে হোক গরীব অথবা ধনী।
আমরা দান দেয়ার আগে পূর্বচেতনায় আনন্দিত হয়ে সুন্দর চেতনা রাখি। দান দেয়ার সময় এবং দেয়ার পরও উৎফুল্ল, আনন্দিত হই। অর্থাৎ দানের পূর্ব চেতনা, মুঞ্চচেতনা এবং অপর চেতনায় সদাসর্বদা উৎফুল্ল থাকি। যদি বাড়িতে সাধু-সন্ন্যাসী-অচেনা পথিক আসে তাদের অন্নব্যঞ্জন, আহার না দিয়ে, সেবা না করে যেতে দিই না।
তিনি আরও বললেন, আচার্য আমি নিজেও আমার স্ত্রী ছাড়া অন্য নারী, আমার স্ত্রীও আমাকে ছাড়া অন্যপরুষের প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করেনা। তাই আমাদের অকালমৃত্যু হয় না।
হে আচার্য, আমরা প্রাণী হত্যাও করি না। আমরা অন্যের সম্পদ চুরি করি না। এমনকি স্থানচ্যুতও করি না।
আমরা সত্যকে মিথ্যা, মিথ্যাকে সত্য বলি না। অন্যের সম্পদ হরণ করি না। আমরা এই চার রকমের রীতি পালন করি বলে আমাদের অকালমৃত্যু হয় না। ভগবান বুদ্ধ তখন জীবিত ছিলেন না। জগৎ রক্ষা করত এই পঞ্চশীলই। তীর্যকলোক, প্রেতলোক, অসুরলোক, নরকলোক এই চার অপায়ে যেতে হবে বলে আমরা সদাসর্বদা সত্য পথে, ধর্ম পথে চলি। শুধু আমরা নই আমাদের সেবাকারী দাস-দাসীরাও পঞ্চশীল ভঙ্গ করে না।
পঞ্চশীল পালন করেই আমরা আমাদের জীবনকে সুন্দরভাবে রক্ষা করি। কথায় আছে, যিনি ধর্ম পালন করেন ধর্ম তাকেই রক্ষা করেন। এরূপ দান, শীলসহ ১০টি কুশলকর্ম করে থাকি। এবং ১০টি অকুশল কর্ম করা থেকে বিরত থাকি। রোগব্যাধি থেকে মুক্ত থাকতেও আমরা ধর্ম পালন করে থাকি। কুশল কর্মের মাধ্যমে আমরা পুণ্য সঞ্চয় করি তাই আমরা দীর্ঘায়ু লাভ করি।
এই ১০ রকমের কুশলকর্মগুলো হলঃ
১/প্রাণী হত্যা না করা
২/চুরি না করা
৩/ মিথ্যা কথা না বলা
৪/মিথ্যা-কামাচার থেকে বিরত থাকা
৫/পিসুনবাক্য না বলা। অর্থাৎ দুজনের মধ্য বিভেদ সৃষ্টি না করা।
৬/ফারুসাওয়াচা না করা। গালিগালাজ, অশ্রাব্য ভাষা, কটুক্তি, অশ্লীল কথা বলা থেকে ববিরত থাকা। যেমনঃ বংশের/মা-বাবার নাম তুলে গালিগালাজ না করা।
৭/ তুচ্ছ, মূল্যহীন কথা না বলা। অর্থাৎ নির্বাণপ্রদায়ী ধর্মকথা বলা।
৮/হিংসা না করা, অন্যের সম্পত্তি আত্মসাৎ না করা।
৯/অন্যের ক্ষতি না করা, প্রাণনাশের হুমকি না দেয়া।
১০/ মিথ্যা দৃষ্টিসম্পন্ন না হয়ে নির্বাণ পথগামী সম্যক দৃষ্টিসম্পন্ন হওয়া।
আর এই ১০ রকমের কুশলকর্মের বিপরীত হচ্ছে ১০টি অকুশল কর্ম।
হে আচার্য বুদ্ধের নির্বাণপ্রদায়ী ধর্মের ত্রি-শাসন (পরিয়ত্তি, প্রতিপত্তি, প্রতিবেধ)কে যিনি রক্ষা- চর্চা করবেন তাঁর অকালমৃত্যু হবে না। তখন আচার্য বললেন, মহাধর্মপাল আমাকে ক্ষমা করুন, আমাকে এই শিক্ষা দিন। এরপর আচার্য ১০ রকমের কুশল ও অকুশল কর্মের শিক্ষা নিয়ে ফিরে গেলেন তক্ষশীলায়।
সাধু সাধু সাধু
Copypost : সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুক থেকে সংগৃহীত ।