পুরাকালে বোধিসত্ত্ব এক এক দূর গ্রামে এক ধনী ব্রাহ্মণকুলে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর নাম রাখা হয়েছিল রক্ষিত কুমার। বয়ঃপ্রাপ্তির পর তিনি তক্ষশীলায় গিয়ে বিদ্যা শিক্ষা করেন। তারপর বাড়ি ফিরে এসে বিবাহ করেন।
এরপর তাঁর মাতা পিতার মৃত্যু হলে তিনি সঞ্চিত ধন দেখে বিষয়বৈরাগ্য জাগল তাঁর মনে। তিনি দান করে সমস্ত ধন শেষ করে দিলেন। তারপর বিষয়বাসনা ত্যাগ করে হিমালয়ে চলে গিয়ে ঋষি প্রবজ্যা গ্রহন করলেন। তিনি সেখানে বন্য ফলমূল খেয়ে একটি পর্ণশালায় বাস করতে লাগলেন। তিনি ধ্যানভিজ্ঞা লাভ করলেন। অনেক তাপস তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহন করল এবং ক্রমে তাঁর শিষ্যত্ব পাঁচশত হল।
একদিন এই সমস্ত তাপস আচার্য বধিসত্তের নিকট গিয়ে বললেন, আচার্য বর্ষাকাল উপস্থিত। আমরা এখন হিমালয় হতে নেমে লবণ ও অম্ল সংগ্রহের জন্য জনপদে গিয়ে ভিক্ষা করি। এতে আমদের শরীর সবল হবে এবং পদব্রজে তীর্থযাত্রাও হবে।
বোধিসত্ত্ব বললেন, যদি ইচ্ছা জয় তাহলে তোমরাই যাও। আমি এখানে থাকব।
তখন শিষ্যরা তাঁকে প্রণাম করে হিমালয় থেকে নেমে জনপদে ভিক্ষা করতে করতে বারাণসীতে গিয়ে উপস্থিত হলেন। তাঁরা রাজ্যধ্যানে বাস করতে লাগলেন। নগরবাসীরা বিশেষ সম্মানের সঙ্গে তাদের আদর অভ্যর্থনা করল।
তারপর একদিন বারণসী নগরে এক জায়গায় বহু লোক সমবেত হয়ে মঙ্গল প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা করতে লাগল। কিন্তু সেখানে উপস্থিত সব লকের সংশয় ছেদন করে কেউ মঙ্গল প্রশ্নের উত্তর দিতে পারল না। তখন সেই সব লোক রাজ্যধ্যানে গিয়ে সেই সব তাপসদের ঐ প্রশ্নের উত্তর জিজ্ঞেস করল। বারণসীরাজ নিজেও সেই আলোচনাসভায় ছিলেন। তিনি সকলের সঙ্গে উদ্যানে তাপসদের কাছে গেলেন। তখন তাপসগণ রাজাকে বললেন, আমরা ঐ প্রশ্নের উত্তর দিতে অক্ষম। আমাদের আচার্য মহাপ্রাজ্ঞ। তিনি হিমালয়ে থাকেন। তিনি দেবতা ও মনুষ্য সকলের হৃদয় জয় করে সেই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেন।
রাজা বললেন, হিমালয় অতি দূর ও দুর্গম। আমি সেখানে যেতে পারব না। আপনারা দয়া করে আচার্যের কাছে গিয়ে সেই প্রশ্নের উত্তর শূনে ফিরে এসে আমাকে বলুন।
শিষ্যরা এতে সম্মত হয়ে হিমালয়ে চলে গেলেন। তাঁরা আচার্যকে প্রণাম করলে আচার্য তাদের জিজ্ঞাসা করল, রাজা কি ধার্মিক? জনপদে লকের চরিত্র কেমন দেখলে?
শিষ্যরা এই প্রশ্নের উত্তর দেবার পর রাজার মঙ্গল প্রশ্নের সব কথা বললেন। বললেন, এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার জন্যই রাজা তাঁদেরকে এখানে পাথিয়েছেন। অনুগ্রহ করে এই প্রশ্নের উত্তর আমাদেরকে বুঝিয়ে দিন। তাঁরা একটি গাঁথার মাধ্যমে বললেন, স্বস্ত্যয়নকালে লোকে কোন বেধ, কোন সুত্ত পাঠ করে? টা কিভাবে জপ করে? ইহামুত্র কিভাবে সুরক্ষিত হবে?
তখন বোধিসত্ত্ব কয়েক্তি গাথায় মঙ্গল প্রশ্নের উত্তর দিলেন। তিনি সব গাঁথার মাধ্যমে বলতে লাগলেন, দেবগণে, পিতৃগণে, সরীসৃপ আদিজীবগণে যে জন মৈত্রীগুণ দ্বারা তুস্ত করে সে সর্বদা সবার প্রীতি লাভ করে এবং এতে ভূত স্বস্ত্যয়ন সম্পন্ন হয়।
যারা সবিনয় ব্যবহারে নরনারী, স্ত্রীপুত্র পরিবার ও সর্বভূত পরিতুষ্ট হয়, যে ব্যক্তি অপ্রিয়বাদীদের প্রীয় ও মিস্তবাক্যদ্বারা তুস্ত করে এবং ক্ষমার অবতারের মত শোভা পায়, সে ইহলোক ও পরলোকে সর্বত্র মঙ্গল্ভাজন হয়। তার কোন শত্রুভয় থাকে না। এতেই হয় তার অধিবাস স্বস্ত্যয়ন।
আমি বিদ্যাবলে, কুলমানে, জাতিতে ধনে বড় বলে যে কখনো আস্ফালন করে না, বাল্যবন্ধুকে আত্মজ্ঞানে দেখে এবং কখন তার অপমান করে না, যে ব্যক্তি সাধু, প্রাজ্ঞ ও মতিমান, সে ব্যক্তি অনায়াসে কারজ বিচার করতে পারে, সে সহায় বা বাল্যবন্ধুদের প্রিয় হয় এবং এভাবেই তার সহায়ক স্বস্ত্যয়ন হয়।
যে জন সাধু ব্যাক্তির সাথে মিত্রতা করে মিত্রের বিশ্বাস ভাজন হয়, যে জন আত্মত্যাগী এবং মিত্রকে ধনের ভাগ দেয়, তার মিত্র সবস্ত্যন হয়।
যার স্ত্রীসমান গুণসম্পন্না, ধর্মপরায়ণা, অবন্ধ্যা ও কুলশীলে ধন্যা, তার দ্বার স্বস্ত্যয়ন হয়।
যার রাজা প্রতাপশালী, যশে,মানে, শীলে, তেজে অদ্বিতীয়, যাকে বন্ধুভাবে গ্রহন করে দ্বিধাহীন চিত্তে, সেই ব্যক্তি এতে রাজস্বস্ত্যয়ন হয়।
যে জন শ্রদ্ধার সঙ্গে অন্নদান, মাল্য ও গন্ধবিনোদন প্রসন্নচিত্তে দান করে সকলের মঙ্কে প্রীত করে, তার স্বর্গস্বস্ত্যয়ন হয়।
জ্ঞানবৃদ্ধ সুবিখ্যাত ও শীল্বান ঋষিগণে যে জন অর্চনা করে এবং তাদের কৃপাবলে যার মন শুদ্ধাচারে আর্য ধর্মে রত হয়েছে, যে জন সাধুসঙ্গপরায়ণ ও শ্রদ্ধাবান, তার নিঃসন্দেহে অর্হৎ স্বস্ত্যয়ন সম্পন্ন হয়েছে।
বোধিসত্ত্ব এইভাবে আটটি গাঁথার দ্বারা মঙ্গল প্রশ্ন সম্বন্ধে উপদেশ দিয়ে তার ব্যাখ্যা করলেন। তারপর বললেন, যারা বুদ্ধিমান, তারা এইভবে স্বস্ত্যয়ন করে চলে। নিমিত্ত অসত্য। তাই তার প্রয়োজন নেই।
শিষ্যরা প্রকৃত মঙ্গল কি তা জেনে নিয়ে আশ্রমে সাত আটদিন কাটিয়ে বারাণসীতে ফিরে গিয়ে রাজাকে মঙ্গল-প্রস্নের উত্তর দিলেন। সকলে প্রকৃত মঙ্গল কি তা জেনে মঙ্গল কর্মের অনুষ্ঠান করতে লাগল। এরপরে তাপসেরা হিমালয়ে ফিরে গেলেন।
বোধিসত্ত্ব ব্রহ্মবিহার ধ্যান করতে করতে ব্রহ্মলোক প্রাপ্তির উপযুক্ত হলেন।
সুত্র ঃ জাতকসমগ্র