বোধিসত্ত্ব একবার বণিকের ঘরে জন্ম গ্রহন করেছিলেন। সেখানে তিনি বাণিজ্য করতে প্রবৃত্ত হন। তাঁর পাঁচশ গরুর গাড়ি ছিল। সেই সব গাড়িতে পণ্য বোঝাই করে নানা স্থানে বানিজ্য করে বেরাতেন তিনি।
একবার তিনি বাণিজ্যে বের হয়ে এক মরুভুমিতে প্রবেশ করেন। সেই মরুভুমির বালি এত সূক্ষ্ম ছিল যে তা হাতের মুঠোই ধরা জেত না, ধরলেই আঙ্গুলের ফাঁক দিয়ে পড়ে যেত। সুজ্র ওঠার সঙ্গে সঙ্গে সেই বালি আগুনের মত গরম হয়ে উঠত। তার উপর ৡদিয়ে আর পথ চলা যেত না।
তাই অনন্যা পথিকের মত দিনের বেলায় এক জায়গায় শিবির খাটিয়ে বিশ্রাম করে, রাত্রিকালে পথ চলতেন। সেখানে নাবিকদের মত মরুপথিকদের রাত্রিকালে নক্ষত্র দেখে পথ চলতে হত। নক্ষত্রঙ্ক দেখে যারা পথ চিনতে পারত তাদের বলা স্থান-নিয়ামক। সব মরুযাত্রিদের দলে একজন করে স্থান-নিয়ামক থাকত।
বোধিসত্ত্বের দলেও একজন স্থান-নিয়ামক ছিলেন। সে রাত্রত্তিবেলা কোন পথে যেতে হবে তা বলে দিতেন। সেদিন বোধিসত্ত্ব ভাবলেন, আজ রাতেই আমরা মরু অঞ্চল পার হয়ে যেতে পারব।
কিন্তু সেই রাত্রেই তাঁর স্থান-নিয়ামক সাম্নের গাড়িতে বসে থেকে গুমিয়ে পড়ার ফলে পথ দেখাতে পারেনি। ফলে সব গাড়িগুলো উল্টো পথ চলতে থাকে।
এদিকে সেই রাত্রিতেই মরুভুমি পার হয়ে যাবে ভেবে বোধিসত্ত্ব সন্ধার আহারের পর জল কাঠ প্রভৃতি অনেক দ্রব্য অনাবশ্যক ভেবে ফেলে দেবার আদেশ দেন।
গাড়িগুলো উল্টো পথ ধরে সারারাত চলে। ভোঁর বেলায় স্থান-নিয়ামকের ঘুম ভাঙলেই তিনি গাড়ি ঘুরাও, গাড়ি ঘুরাও বলে চিৎকার করে উঠলেন। কিন্তু তখন কোনও উপায় নেই। সূর্য উঠে পড়েছে। দেখা গেল যেখান থেকে তারা যাত্রা করেছিল সেইখানেই এসে পোঁছেছে।
তখন আনুচরেরা বলতে লাগল, আমরা জল, কাঠ সব ফেলে দিয়েছি। এখন আমরা কি খেয়ে বাঁচব? এই বলে বিলাপ করতে করতে আনুচরগণ গাড়ি থামিয়ে গরুগুলিকে খুলে দিয়ে হতাশ হয়ে গারিগুলর তলায় শুয়ে পড়ল।
কিন্তু চরম বিপদে ধৈ্র্য্য ধারণের অসীম ক্ষমতা ছিল বোধিসত্ত্বের। তিনি ভাবলেন, তিনি এখন নিশ্চেষ্ট হয়ে বসে থাকলে এতগুলি প্রানী অকালে মারা যাবে। এই ভেবে তিনি জলের সন্ধানে ইতস্ততঃ ঘুরে বেড়াতে লাগলেন। কিছুদূর গিয়ে এক জাইয়গায় এক গুচ্ছ কুশ ডেকতে পেলেন। তখন তিনি বুজতে পারলেন নিশ্চয়ই এর তলায় জল আছে। তা না হলে মরুভুমিতে কুশ জন্মাতে পারে না।
এই ভেবে তিনি তাঁর অনুচরদের কোদাল দিয়ে কুয়ো খনন করতে বলেন। কিন্তু অনেক মাটি কেটে ষাট হাত নীচেও জল পাওয়া গেল না। উল্টো দেখা গেল সেইখানে মাটি নেই, শুধু পাথর। পাথরে কোদালে কোনও চোট লাগল না। বোধিসত্ত্ব তখন নীচে নেমে গিয়ে সেই পাথরের উপর কান পেতে ভিতরে জল প্রবাহ শুনতে পেলেন। বুঝতে পারলেন সেই পাথরের নীচে জলের ধারা বয়ে যাচ্ছে।
তখন তিনি উঠে এসে তাঁর এক যুবক ভৃত্যকে বললেন, তুমি একটা বড় হাতুড়ী নিয়ে নীচে নেমে গিয়ে পাথরের উপর ক্রমাগত ঘা মারতে থাকে। ওর তলায় জলের ধারা বয়ে যাছে। তুমি এ বিষয়ে উদ্যমহীন হলে সকলেই মারা যাবে।
যুবকটি বলিষ্ঠ ও উদ্যমশীল ছিল । অন্য সকলে হতাশ হয়ে বসে পরলে সে একা বিশেষ উৎসাহের সাথে প্রভুর আদেশ পালন করল । তখনি সেই পাথর ফেটে স্বচ্ছ জলের এক ফোয়ারা বেগে উঠে এল । তখন সকলের আনন্দ আর ধরে না । সবাই সেই জলে স্নান করল, পানের জল তুলে রাখল প্রচুর পরিমাণে । তারপর রান্নার ব্যবস্থা করল । সঙ্গে প্রয়োজনের অতিরিক্ত কিছু কাঠের দ্রব্য ছিল । সেগুলি চিরে জালানি কাঠ হিসেবে ব্যবহার করা হল ।
খাওয়া দাওয়ার পর সন্ধার সময় তারা গন্তব্য স্থানের পথে রওনা হয়ে পড়ল । এরপর তারা যথাসময়ে বাণিজ্যস্থানে পোঁছে গেল । সেখানে বোধিসত্ত্ব তাঁর সমস্ত পণ্য দ্বিগুণ লাভে বিক্রি করে প্রচুর লাভ করলেন। এইভাবে কাজ সেরে স্বদেশে ফিরে এলেন ।
কোন কাজে ব্যর্থ হয়ে জ্ঞানীজন চুপ করে বসে থাকেন না, অধ্যাবসায়ের সঙ্গে কাজ করে সাফল্য লাভ করেন ।
সুত্র ঃ জাতকসমগ্র