৪ঠা অক্টোবর, ১৯৯৬ ইংরেজী। ভোর বেলায় শ্রদ্ধেয় বনভান্তে তাঁর শিষ্যদেরকে ধর্মদেশনা দিচ্ছিলেন। প্রথমেই তিনি বলেন- তোমরা কি জন্যে ভিক্ষু শ্রামণ হয়েছ? আর না অন্য কিছু? কেউ কেউ যাত্রা দলের অভিনয়ের মত ভিক্ষু শ্রামণ হয়ে থাকে। তা কি রকম জান? যেমন যাত্রা দলে কেউ রাজা হয়, রাজার বেশ ধারণ করে, কেউ প্রজা, প্রজার বেশ ধারণ করে। অন্যান্য জন অন্যান্য জনের বেশ ধারণ করে থাকে। তোমরাও ভিক্ষু শ্রামণের বেশ ধারণ করে ভিক্ষু শ্রামণের অভিনয় করতেছ নাকি? যারা অভিনয়কারী তারা রাত্রে অভিনয় করে দিনে নিজ নিজ পোশাক পরিধান করে। ঠিক সে রকম তোমরাও যাত্রা দলে অভিনয় কর না। সত্য সত্যই ভগবান বুদ্ধের নীতি অনুসরণ করে প্রকৃত ভিক্ষু শ্রামণ হও।

তিনি বলেন- সত্য দুই প্রকার। ব্যবহারিক সত্য ও পারমার্থিক সত্য। অন্য নামে বলা যায়- লৌকিক ও লোকোত্তর। লৌকিক- মা-বাপ, ভাই-বোন, স্ত্রী-পুরুষ, ধন-সম্পদ প্রভৃতিকে বুঝায়। লোকোত্তরে মা-বাপ, ভাই-বোন, স্ত্রী-পুরুষ, ধন-সম্পদ প্রভৃতি কিছুই নেই (বুঝায়)। লৌকিক গুলি স্বপ্ন সদৃশ, লোকোত্তর গুলি বাস্তব। যেমন একজন লোক রাত্রে ঘুমের সময় দুই মণ স্বর্ণ পেয়েছে, দিনে সে গুলি নেই। অন্যজন সত্যি সত্যিই দুইমন স্বর্ণ পেয়েছে। প্রথম জন পেল কল্পনা প্রসূত এবং দ্বিতীয় জন পেল বাস্তবে। প্রথম জন হল লৌকিক ও দ্বিতীয় জন হল লোকোত্তর।

তিনি আরো বলেন- যেমন ধর, একজন লোক স্ত্রী পুত্র ছেড়ে ভিক্ষু হয়েছে। যদি সে তাদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখে তার কি ছাড়া হয়েছে? চিত্তের মধ্যে স্থান দিলেও ছাড়া হবে না। আন্দাজ করে ছাড়লেও ছাড়া হবে না। সিদ্ধার্থ গোপাকে যেমন করে ছেড়ে দিয়েছেন তেমন করে ছেড়ে দিতে হবে।

রাজা মিলিন্দ ভিক্ষু নাগসেনকে প্রশ্ন করেছিলেন- শ্বেত বস্ত্র নিয়ে মার্গফল ও নির্বাণ লাভ করতে পারে কিনা? আচ্ছা, এখন তোমরা কোন দিকে বলবে? তোমরা যেদিকে উত্তর দিবে সেদিকে ধরা পড়বে। ভগবান বুদ্ধের সময়ে একজন নূতন ভিক্ষুকে প্রশ্ন করেছিল। তিনি বললেন- আমি নূতন ভিক্ষু। সুতরাং ভগবান বুদ্ধকে প্রশ্ন করতে পারেন। সে রকম তোমাদেরকে প্রশ্ন করলে বলবে আমাদের গুরু শ্রদ্ধেয় বনভান্তের নিকট প্রশ্ন করুন।

তিনি বলেন- কে খায়? কে খায় না? লোভ ও তৃষ্ণায় খায়। লোভ ও তৃষ্ণা না থাকলে খাবে না। খেলে দেবে, না খেলে কিছুই দেবে না। তাহলে উপায় কি? লোভে আহার করে। তৃষ্ণায় আহার করে। লোভ, তৃষ্ণা নিরোধ করে আহার করলে লোভ তৃষ্ণা মুক্ত হয়। আহার চার প্রকার- স্থূল আহার, স্পর্শ আহার, বেদনা আহার ও বিজ্ঞান আহার। এ আহার গুলি কিভাবে নিরোধ করবে? আর্য্য অষ্টাঙ্গিক মার্গই আহার নিরোধের একমাত্র উপায়। যতক্ষণ পর্যন্ত আহার নিরোধ না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত মুক্ত হতে পারবে না।

আচ্ছা যদি কেউ তোমাদেরকে নির্বাণ সম্বন্ধে প্রশ্ন করে- নির্বাণ আধ্যাত্মিক না বাহ্যিক? চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা, ত্বক ও মন আধ্যাত্মিক- রূপ, রস, শব্দ, গন্ধ, স্পর্শ ও স্বভাব ধর্ম বাহ্যিক। এগুলির মধ্যে কোথায় নির্বাণ? কোথায়ও নেই নির্বাণ। বাতাস যেমন শরীর দ্বারা অনুভব করা যায় নির্বাণ ও চিত্তের দ্বারা অনুভব করা যায় মাত্র। চর্ম চক্ষে নির্বাণ দৃষ্টি গোচর হয় না।

মহা জ্ঞানী অার্য্যগণ
যে পথে করেছে গমন।
লভিয়াছে সম্যক দর্শন
সেই পথ লক্ষ্য করে
আচরিবে ধৈর্য্য ধরে
সার্থক কর এই জীবন।।

এখানে প্রতীত্য সমুৎপাদ নীতি জ্ঞান সম্পন্ন ব্যক্তি হল মহাজ্ঞানী। যে ধর্ম করলে সুখ ও মুক্ত হয়, সে ধর্মে বিশ্বাসও জন্মে।

শ্রদ্ধেয় বনভান্তে বলেন- আচ্ছা বলদেখি, তোমরা নির্বাণ যেতে যেতে অর্ধপথে নেমে পড়লে যাওয়া কি হবে? যাওয়া হবে না। অনেকে গুন্ডার কবলে পড়ে। গুন্ডা হল নারী। যুবক কেন বৃদ্ধেরা ও গুন্ডার হাতে পড়ে। তোমরা গুন্ডার তালাশ কর না। নির্বাণ তালাশ কর। নির্বাণ ব্যতীত অন্য গুলি পাপ, দুঃখ ও মুক্ত নয়। যাঁরা জ্ঞানী তাঁরা নির্বাণ তালাশ করে। যারা অজ্ঞানী তারা অন্য কিছু তালাশ করে। তোমরা যেগুলি ফেলে এসেছ সেগুলি আবার তালাশ কর না। অবিদ্যা, তৃষ্ণায় লইতে চায় ও থাকতে চায়। অবিদ্যা নিরোধ হলে সব ঠিক হয়। অবিদ্যা, তৃষ্ণা ক্ষয় হলে সব ক্ষয় হয়। সব যদি ক্ষয় হয়ে যায় তার আবার কিসের প্রয়োজন? ট্রেন চলার সময় যদি বিপদ হয় শিখল টানলে পুলিশ রক্ষা করে। ঠিক সেরকম তোমাদের যদি কোন বিপদ আসে ত্রিশরণ ও ত্রিলক্ষণকে স্মরণ কর। ত্রিশরণে পূণ্য ও সুখ হয়। ত্রিলক্ষণে নির্বাণ সাক্ষাৎ লাভ হয়।

তিনি আরো বলেন- এ সংসারে যাবতীয় গন্ডগোল ও ভেজাল কে করেছে? অবিদ্যা, তৃষ্ণায় যাবতীয় গন্ডগোল ও ভেজাল করছে। অবিদ্যা, তৃষ্ণায় অন্যায় স্বীকার করে না, ভুল স্বীকার করে না, অপরাধ স্বীকার করে না এবং গলদ স্বীকার করে না। তাই তিনি কবিতার ছন্দে বলেন-

কোথায় কত ভবে জনম নিয়েছি।
জন্ম মৃত্যু শোক তাপ কত সহেছি
নিদারুন দুঃখ তাপে জর্জরিত এ প্রাণ।
জ্ঞান বলে মুক্ত তবে আজি, গাই মুক্তির গান-
বাঁধিতে পারিবে না আর এ দুঃখ কারাগার।।
মুক্ত হয়েছি আমি লভিব নির্বাণ।।

শ্রদ্ধেয় বনভান্তে বীর বিক্রমে দেশনা করে বলেন- যারা কাপুরুষ তারা নির্বাণ যেতে পারে না, যাঁরা বীর পুরুষ তাঁরা নির্বাণ যেতে পারে।

ভিক্ষুরা ভাত কেন খায়? ভিক্ষুর লাভের জন্যে নয়, মানুষের সুখ হওয়ার জন্যে জীবিতে ইন্দ্রিয় রক্ষা করে নির্বাণ যাওয়ার মার্গ আবিষ্কারের মানসে। নির্বাণে মানুষ নেই, নারী নেই, পুরুষ নেই। মানুষ, নারী, পুরুষ দুঃখ-পাপ ও মুক্ত নয়। মানুষ মিথ্যা ও নারী-পুরুষ মিথ্যা। চিত্তে অবিদ্যা উৎপত্তি হলে চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা, ত্বক ও মনে দুঃখ উৎপত্তি হয়। যদি কেউ বলে সুখ, সেগুলি সুখ নয়, দুঃখ রাশি মাত্র। চারি আর্য্যসত্য উদয় হলে সম্যক দৃষ্টি উদয় হয়। সম্যক দৃষ্টি দুই প্রকার। লৌকিক ও লোকোত্তর সম্যক দৃষ্টি। নারী পুরুষ মরবে ঠিকই কিন্তু কর্ম মরবে না। যতদিন অবিদ্যা, তৃষ্ণা নিরোধ না হয়। তোমরা কর্ম ধ্বংস কর, নিরোধ কর। কর্ম ক্ষয় ও পাপ ধর্ম ত্যাগ করলে পুনজন্ম হয় না, পাপ ধর্ম ত্যাগ করলে নির্বাণ প্রত্যক্ষ হয়। নির্বাণে কর্মও নেই ধর্মও নেই। কিন্তু এ জগতে প্রত্যেককে কর্মফল ভোগ করতে হয়।

# লেখাটি  Subrata Barua  কর্তৃক পোস্ট থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে । 

error: Content is protected !!