পাহাড় সমতল আলোকিত করেছেন যিনি
লিখেছেন – ইলা মুৎসুদ্দি
তিনি যদি আবির্ভূত না হতেন হয়তো এতোদিন আরো অনেক বেশী অন্ধকারে তলিয়ে যেতো পাহাড়ি জনপদের বৌদ্ধ বাসিন্দারা। হয়তো অনগ্রসর আর পিছিয়ে পড়া সমাজে তাদের নাম উঠে যেতো। সেই সাথে সমতলের বৌদ্ধদের মধ্যেও ধর্মের পুনর্জাগরণ হয়তো ঘটতো না। একসময় পাহাড়ি জনপদ ছিল খুবই অশান্ত। সবসময় মারামারি, হানাহানি লেগেই থাকতো। তাদের মধ্যে কোনরকম ঐক্য বা ন্যায় নীতির বাচবিচার ছিল না। এরিই মধ্যে হঠাৎ করে সমস্ত অন্ধকার জগত আলোকিত করে আবির্ভূত হলেন বনভন্তে। রাঙ্গামাটি জনপদে ভান্তে অবস্থান করার পর থেকে ক্রমে ক্রমে পাহাড়ী জনগণের মধ্যে অনেক পরিবর্তন আসতে শুরু করলো। সকলের মধ্যে ধর্মচেতনা জাগতে শুরু করলো। বেশীর ভাগ পাহাড়ী পুরুষ-মহিলা তরুণ ছেলে-মেয়েরা বনবিহারে যাওয়া আসা করতে লাগলো। পর্যায়ক্রমে সমতলের বৌদ্ধরাও বনবিহারে যাতায়াত করতে লাগলেন বনভান্তের দেশনা শোনার জন্য। বনভান্তেকে একনজর দেখার জন্য। আসলে যেখানে সত্যিকারের ধর্মের ভিত রচিত হয়, সেখানে সবকিছুর পরিবর্তন হয়। পাহাড়ী ভাই-বোনদের মধ্যেও বিপুল পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। তাদের পারিবারিক, আর্থিক সামাজিক উন্নয়ন ঘটতে লাগলো। আজ তারা বিভিন্ন সরকারী বেসরকারী বড় বড় পদে কর্মরত।
পাশাপাশি সমতলের বৌদ্ধদের মধ্যেও যুগান্তকারী পরিবর্তন সাধিত হলো। বনভান্তে শিষ্য শ্রামণ ভিক্ষুদের কঠোরভাবে অনুশাসন করে শৃংখলাময় জীবন গঠনের ভিত রচিত করে দিয়েছেন। যার জন্য আমরা লাভ করেছি পুণ্যার্জনের সুযোগ। বুদ্ধের সময়কালীন বুদ্ধ নির্দেশিত পথেই হঠাৎ করে ধীর্ঘ সময়ের পর ভিক্ষুদের সকালে পিন্ডাচরণের মাধ্যমে পিন্ড দানের সুযোগ লাভ। কারণ বনভান্তের শিষ্য মানেই সকালে পিন্ডাচরণ নির্ধারিত। সকলেই খুবই শ্রদ্ধা সহকারে পিন্ড দান দিতে উৎসাহী হয়। ক্রমান্বয়ে পিন্ডাচরণের পরিধি বৃদ্ধি পেতে পেতে আজ শহর এলাকায়ও আমরা পিন্ডাচরণ দিতে পারছি। এমনকি বনবান্তের শিষ্য যারা দেশের বাইরে অবস্থান করছেন তাঁরাও সকালে পিন্ডাচরণ করেন। শহর এলাকা কিংবা সমতলের চাইতে পাহাড়ীদের পিন্ডদানের দৃশ্য দেখলে মন জুড়িয়ে যায়। সত্যিই তাদের দানচেতনা খুবই সুন্দর। কত শ্রদ্ধা সহকারে তারা দান দেয়, শীল পালন করে। আমরা হয়তো একটি কলা কিংবা ৬টি কলা দান করি কিন্তু পাহাড়ী ভাই-বোনেরা দান করে এক ছড়া। হয়তোবা বলা হবে, তাদের বেশী আছে তাই বেশী দান দেয়। আসলে সেটা ভুল কথা। আমাদের মধ্যে অনেকেরও কিন্তু ঐরকম দান করার ক্ষমতা আছে, কিন্তু আমরা তাদের মতন ঐরকম দান সহজে দিতে পারি না।
এভাবেই শুরু হলো পাহাড়ীদের উন্নয়নের ইতিহাস। ক্ষুদ্র আলো আস্তে আস্তে বিকিরণ দিতে দিতে পুরপূর্ণভাবে বিচ্ছুরিত হতে লাগলো। পাহাড় সমতলে ধর্মের জোয়ার সৃষ্টি হলো। পাহাড়ী আর সমতলের জনগণের মধ্যে ঐক্য, সম্প্রীতি সৃষ্ঠি হলো। সকলে মিলেমিশে বিভিন্ন ধর্মীয় কার্যাদি করতে লাগলো। শুধু তাই নয়, বনভান্তের জন্মবার্ষিকী, কঠিন চীবর দান, আকাশ প্রদীপ, ত্রিপিটক বা ধর্ম পূজা, রাত ব্যপি সুত্র শ্রবণ ইত্যাদি। সকলে মিলে ঐক্যবদ্ধভাবে করতে লাগলেন। বনভান্তে প্রথম বুদ্ধের সময়কালীন মহাউপাসিকা বিশাখা কর্তৃক প্রবর্তিত নিয়মে একই দিনে অর্থাৎ ২৪ ঘন্টার মধ্যে কাপড় বুনন, রংকরণ এবং তৈরী করে দান করার পদ্ধতি চালু করলেন। যা বর্তমান সমাজে খুবই প্রচলিত নীতি হিসাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। বর্তমান ডিজিটাল যুগে এসেও মানুষ বিশাখা প্রবর্তিত নিয়মে কঠিন চীবর দান করার উদ্যোগ নিচ্ছে সাড়ম্বরে। বনভান্তে জীবিত থাকাকালীন চেয়েছিলেন পূর্ণাঙ্গ ত্রিপিটক বাংলায় প্রকাশিত হোক। পূজনীয় প্রজ্ঞাবংশ ভান্তেকে দিয়ে শুরু করেছিলেন, যা শেষ হলো ভান্তের মহাপ্রয়ানের পর। শেষ করার অদম্য ইচ্ছা পূজনীয় বনভান্তের শিষ্যদের মধ্যে ছিল বলেই তাঁদের সকলের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় সফল হয়েছেন। সেই মহাত্মা বনভান্তের মহাপ্রয়াণের পর কত তর্ক-বিতর্ক শুরু হয়ে গেল।
যারা এসব করছে তারা একবারও চিন্তা করে দেখে না এসব করে কি বনভান্তের সুনাম ক্ষুন্ন করা যাবে? কিংবা পারা সম্ভব? বনভান্তে যদি ধর্মজ্ঞানে বলীয়ান না হতেন তাহলে আজকের রাঙ্গামাটি রাজবন বিহার এবং অনেকগুলো শাখা বন বিহার সৃষ্টি হতো না। সৃষ্ঠি হতো না সম্যক জ্ঞানসম্পন্ন ভিক্ষু যারা এখনো লোকালয়ে আসেনি, নিভৃতে ধ্যানচর্চা করছে অরণ্যে। বনভান্তের রাজবন বিহার একটি বড় প্রতিষ্ঠানে রূপ নিয়েছে। অসংখ্য শিক্ষিত জ্ঞানী ভিক্ষুর জন্ম এই প্রতিষ্ঠান থেকেই। যাঁরা আজ পূর্ণাঙ্গ ত্রিপিটক প্রকাশনা করে বনভান্তের অসমাপ্ত ইচ্ছা পরিপূর্ণ করেছেন। এ এক বিরল সৌভাগ্য আমাদের। এখনো বনভান্তের জন্মবার্ষিকী এবং মহাপ্রয়াণ দিবসে মানুষের ঢল নামে রাঙ্গামাটি রাজবন বিহারে। কেন? কারণ একটাই বনভান্তের শিক্ষা।