২৯শে সেপ্টেম্বর ১৯৯৬ ইংরেজী রবিবার। ভোরবেলায় শ্রদ্ধেয় বনভান্তে তাঁর শিষ্যদের প্রতি ধর্মদেশনা দিচ্ছিলেন। তিনি প্রথমেই বলেন- প্রতীত্য সমুৎপাদ নীতি জানলে মিথ্যার দিকে না চলে সত্যের দিকে অগ্রসর হতে পারবে। অবিদ্যার কারণে নানাবিধ দুঃখের সৃষ্টি হয়। সে দুঃখ গুলি যতদিন পর্যন্ত ধ্বংস করতে না পারবে ততদিন পর্যন্ত দুঃখ ভোগ করতে হবে। বিদ্যা উৎপত্তি হলে সুখ ও উৎপত্তি হয়। সে সুখ হল আসল সুখ। তিনি কবিতার ছন্দে বলেন-

কোথায় যে কতভাবে জন্ম নিয়েছি।
জন্ম মৃত্যু শোকতাপ কত যে সহেছি।।
নিদারুন দুঃখ তাপে জর্জরিত এপ্রাণ।
মুক্ত তবে আজি বাঁধিতে পারিবে না-
এ দুঃখ কারাগার।।

যে প্রতীত্য সমুৎপাদ নীতি বুঝতে পারে, জানতে পারে ও পরিচয় হতে পারে সে মার ভুবনে থাকে না। মার ভুবন অধীন, ভয়ংকর ও দুঃখ।

তিনি উপমায় বলেন- তোমরা মাছের ফাঁদ (চাঁই) চেনো? মাছ যেমন ফাঁদ চিনে না। অনায়াসে ফাঁদে পড়ে প্রাণ হারায়। ঠিক সেরকম পুরুষের (নারীর) ফাঁদ হল নারী (পুরুষ)। যারা অজ্ঞানী তারা এ ফাঁদে পড়ে অনন্তকাল পর্যন্ত দুঃখ ভোগ করতে থাকে। অন্যটা হল মারের ফাঁদ। যারা কামলোক, রূপলোক ও অরূপলোকে থাকবে তারা মারের ফাঁদে পতিত হবে। মার এ ত্রিলোক থেকে মুক্ত হতে দেয় না। মাছ যেমন চাঁই চেনে না, অন্ধজনও ভব কারাগার চিনে না। তারা ভব কারাগারে পড়ে সহজে মুক্ত হতে পারে না। যাঁরা জ্ঞানী তাঁরা নারী-পুরুষের চাঁই ও মারের চাঁই এ প্রবেশ করে না। তাহলে তোমরা বল- ওহে মনচিত্ত, চাঁই এর ভিতর যেয়ো না। সাবধান, সেদিকে মনচিত্ত দিও না। নির্বাণ হল চাঁই এর বাইরে ও মুক্ত। তোমরা নির্বাণের মন ও নির্বাণের চিত্ত কর। বিদর্শন ভাবনা করলে জ্ঞান চক্ষু উদয় হয় এবং চাঁই এর ভিতরে ঢুকতে হয় না।

শ্রদ্ধেয় বনভান্তে বলেন- বিড়াল বাঘের মত হলেও বাঘ হতে পারে না। শুকর ভালুকের মত ঘু ঘু করলেও ভালুক হতে পারে না। সকল পন্ডিত এক সমান হতে পারে না। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় কেউ কেউ সামান্য কিছু জেনেও বড় পন্ডিতের মত নিজকে প্রমাণিত করতে চায়। পন্ডিত কাকে বলে?- যাঁরা সহনশীল, জীবের প্রতি দয়া, ক্ষমা, মৈত্রী ও পূণ্য কর্মে নির্ভীক এবং সর্বদা অক্ষুন্নমনা ব্যক্তিকে পন্ডিত বলে।

তিনি বলেন- বর্তমান যুগে জড়বিজ্ঞানের অগ্রগতিতে সাধারণ মানুষ হতভম্ব হয়ে পড়েছে। এ বিজ্ঞান গুলিও এক প্রকার যাদুর মত। চারি আর্য্যসত্য ও প্রতীত্য সমুৎপাদ নীতি জ্ঞান উদয় হলে বর্তমান যুগের বিজ্ঞানের কর্মকান্ড কিছুই নেই। জড় বিজ্ঞানের বহু দোষ আছে। যেমন- মানুষ মারার কলা-কৌশলাদি। নির্বাণে আজে বাজে গন্ডগোল ও ভেজাল নেই।

তিনি একটি উপমা দিয়ে বলেন- শংখ মার্কা খাঁটি সরিষার তৈলের টিনে লেখা থাকে- ভেজাল প্রমাণে এক হাজার টাকা পুরষ্কার। তেমনি খাঁটি বৌদ্ধ ধর্ম বা নির্বাণ ধর্ম যে পালন করে তার জন্যেও পুরষ্কার আছে। সে পুরষ্কার হল পরম বিমুক্তি সুখ নির্বাণ। নির্বাণ হল ভেজাল বর্জিত।

শ্রদ্ধেয় বনভান্তে কায়গতানু স্মৃতি ভাবনার উপর জোর দিয়ে বলেন- তোমরা নারীদের প্রলোভনে পড়না। যারা ৩২ প্রকার অসূচী ভাবনা করবে তারা কখনো নারীর (পুরুষের) প্রতি আকৃষ্ট হয় না। এদেহ অনিত্য, এদেহ দুঃখ পূর্ণ, এদেহ অনাত্ম, এদেহ দোষ পূর্ণ, এদেহ মুক্তির বিঘ্নকারক বলে সাধু পুরুষেরা সর্ব দুঃখের আধার এদেহকে ত্যাগ করে পরম সুখ নির্বাণ লাভ করে থাকেন।

গলিত অসূচী দেহ পচনেই সার।
রক্ত মাংস মল মূত্র পুঁজের ভান্ডার।।
ক্ষয় লয় দুঃখ শুধু অনাত্ম লক্ষণ।
অহরহ কর কায়ে কায়ানু দর্শন।।
অসূচী লক্ষণ দেখে স্মৃতির সাধনে।
প্রজ্ঞার আলোক জ্বালাও অনিত্য দর্শনে।।
স্মৃতি প্রজ্ঞা বলে দেখ চিত্ত ক্ষয় ক্ষন।
ক্ষয় ব্যয় দেখে কর আসক্তি বর্জন।।
বিদর্শন জ্ঞান চক্ষু কর উম্মিলন।
রূপ স্কন্ধ দেখ ঘৃণ্য অশুভ লক্ষণ।।
বেদনার অনুভূতি দুঃখ হাহাকার।
ক্ষনেতে ভোজবাজি অনিত্য সংসার।।

তিনি বলেন- পঞ্চস্কন্ধ অনিত্য, দুঃখ ও অনাত্ম। পঞ্চস্কন্ধ নিত্য, সুখ ও আত্মা বললে বিপরীত বলা হবে। ওহে মন, তুমি সেদিকে যেয়োনা। জ্ঞানীরা অসূচীর ফাঁদে পড়ে না। তারা পঞ্চস্কন্ধ যে অনিত্য, দুঃখ ও অনাত্ম তা ভাল ভাবে দেখে তাতে আসক্ত হয় না। একবার ভগবান বুদ্ধ জনৈক নারীর প্রতি উৎকন্ঠিত যুবক ভিক্ষুকে এ উপদেশ দিয়ে মুক্ত বা অর্হত্ব প্রতিষ্ঠিত করেছেন।

তিনি কবিতার ছন্দে বলেন-
কে বা কাহার তুমি, অনিত্য রঙ্গভূমি।
কর্মশেষে তুমি আমি সব হবে বিসর্জন।।
দুনিয়ার ব্যাপার বড়ই চমৎকার।
আপন কর্মে ঘুরছে মানুষ ভাবে নাকো একবার।।
আমি বুঝি আমি শুধু পাকা।
আর বুঝি অন্য কেউ সবাই বোকা।।

উপসংহারে তিনি বলেন- কেউ কেউ মনে করে আমি একমাত্র বৌদ্ধ শাস্ত্রে সুপন্ডিত। অন্যকেউ কিছু জানেনা। এ কুৎসিৎ ধারণা বলতে গিয়ে সদ্ধর্মের প্রতি গ্লানি করা হয় মাত্র। তাহলে পন্ডিত কাকে বলে? পূর্বেও বলা হয়েছে তবুও পুনঃর্বার বলা হচ্ছে। যার সহনশীলতা আছে, জীবের প্রতি দয়া আছে, ক্ষমা আছে, মৈত্রী আছে ও পূণ্য কর্মে নির্ভীক এবং সর্বদা অক্ষুন্ন মনা ব্যক্তিরা পন্ডিত নামে অভিহিত হন। সুতরাং তোমার পন্ডিত হওয়ার জন্যে দৃঢ় প্রচেষ্টায় এগিয়ে চল। যেন আসল পন্ডিত হতে পার।

#লেখাটি  Subrata Barua  কর্তৃক পোস্ট থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে । 

error: Content is protected !!