জাতক

আনন্দ শ্রেষ্ঠী

মাৎসয্য উন্নত লাভের প্রধান বাঁধা । সে হীনমন্যতা নিয়ে বাঁচতে চায় । আপনার যাহা সম্পদ , তাহা নিজের প্রয়োজনের জন্য অপরকে বিলিয়ে দিতে বা দান করতে নারাজ। উদারতা, বদান্যতা ও মহত্ত প্রভৃতি গুন ধর্ম তার অনতরে থাকে না । তার এই হীন , নীচ মনোবৃত্তিটা দ্বেষ চিত্তেই উৎপন্ন হয়ে থাকে ।তার প্ররিণতি হয় দুঃখ , দুর্ভোগ ও অশান্তি । এই সম্পর্কে একজন ব্যাক্তির জীবন কাহিনি তুলে ধরছি –

বুদ্ধের সময়কালে শ্রাবস্তির জেতবন কৌশল রাজ্যের অন্তভুক্ত ছিলেন । অনাথপিন্ডিক নির্মিত এই জেতবন বিহার বৌদ্ধ উপাসক ও উপাসিকাগ্ণের তীর্থক্ষেত্রে পরিনত হয়েছিলো । কারণস্বয়ং ভগবান বুদ্ধ এই বিহারে ১৯ বৎসর বরসাব্রত যাপন করেছিলেন। কোশলের সমগ্র রাজ্যে ৭ কোটি জনগণের বাস । তাদের মধ্যে ৫ কোটি আরযশ্রাবক,২ কোটি পৃথক জন । প্রতিদিন জেতবন বিহারে লক্ষ লক্ষ মানুষের সমাগম হত। ভগবান বুদ্ধ সেই বিহারে আগত জনগ্ণকে স্বর্গ এবং মোক্ষ মার্গ প্রসঙ্গে ধরমদেশনা করতেন ।

আমার পুত্র আছে । এই ধর্মদেশনা বুদ্ধ শ্রাবস্তীতে অবস্থানকালে আনন্দ শ্রেষ্ঠীকে উদ্দেশ্য করিয়া বলিয়াছিলেন । শ্রাবস্তিতে আনন্দ শ্রেষ্ঠী নামে চল্লিশকোটি বিভর সম্পন্ন অথচ মহাকৃপণ এক ব্যাক্তি ছিলেন। তিনি মাসের প্রতি পক্ষে জ্ঞাতিগ্ণকে একত্রিত করিয়া পুত্র মুলশ্রীকে তিন বেলা উপদেশ দিতেন

এই চল্লিশ কোটি ধন অনেক বেশী “ এই কথা মনে করিও না । যে ধন আছে তা দিবে না । নতুন ধন উৎপাধন করিতে হইবে । এক একটি কারজাপণ করিতে করিতে ধন ক্ষয়প্রাপ্ত হয় । সেইজন্য –

তিনি অন্য এক সময় নিজে পঞ্চ নিধির কথা পুত্রকে না জানাইয়া ধনগর্বিত ও কার্পণ্যদোষদুষ্ট হইয়া কালগত হইয়া সেই নগরেরই দ্বারপ্রদেশে বসবাসকারী সহস্র চন্ডাল পরিবারের এক চন্ডালির গর্ভে প্রতিসন্ধি গ্রহণ করিলেন (গর্ভে উৎপন্ন হইলেন ) রাজা তাহার মৃত্যু সংবাদ শুনিয়া পুত্র মুলশ্রীকে ডাকাইয়া শ্রেষ্ঠীস্থানে প্রতিষ্ঠিত করিলেন । সেই সহস্র চন্ডাল পরিবার একত্রে জিবিকা অর্জন করিয়া জীবন ধারণ করিত । কিন্তু সেই (কৃপণ শ্রেষ্ঠী ) ব্যাক্তি প্রতিসন্ধি গ্রহণের পর হইতে তাহাদের জীবিকা বন্ধ হইয়া গেল। তাহারা দিন যাপন করিবার জন্য পিন্ডমাত্র অন্নও লাভ করিত না । তাহারা ভাবিল – আমরা এখন কাজ করিয়াও পিন্ডমাত্র অন্নও লাভ করিতেছি নাআমাদের মধ্যে কোন কালকর্নীর আবিরভারব হইয়াছে বোধ হয় । এই বিষয়কে কেন্দ্র করিয়া সমস্ত চন্ডাল পরিবার দ্বিধাবিভক্ত হইল। গর্ভস্ত কৃপণ শ্রেষ্ঠীর মাতাপিতাও একে অন্য হইতে আলাদা হইয়া গেল । তখন তাহারা দৃঢ় নিশ্চয় হইল যে একই পরিবারেই কালকর্নী জন্মিয়াছে এবং তাহারা ঐ চন্ডালিকে বহিস্কৃত করিল । সেও (চন্ডালি) যতদিন সে (কৃপণ শ্রেষ্ঠী ) কূক্ষিগত ছিল ততদিন অতি কষ্টে জীবন অতিবাহিত করিয়া পুত্রের জন্ম দিল । কিন্তু তাহার হাত , পা , চোখ , কান , নাক যতাস্থানে ছিল না । সে এইরুপ অঙ্গবৈকল্য যুক্ত হওয়াতে পান্ডুপিশাছের ন্যায় কুৎসিতদর্শন হইছিল। ততসত্তেও মাতা তাঁহাকে প্ররিত্যাগ করিল না । যাহাকে গর্ভে ধারন করা হয়, তাহার প্রতি স্নেহ বলবান হয়। সে তাঁহাকে অতি কষ্টে লালন পালন করিতে লাগিল । পুত্রটি এতই অভাগা যে যেইদিন পুত্রকে সঙ্গে নিয়ে যাই ঐদিন সে কিছুই পাই না । আর যেইদিন পুত্রকে রাখিয়া যাই সেইদিন কিছুনা কিছু পাইতো । যখন ছেলেটি বড় হইল অথাৎ স্বয়ং ভিক্ষার জন্য জিবিকা নির্বাহ করিতে পারিবে মনে হইল তখন মা তাঁহার হাতে একটি ভিক্ষাপাত্র দিয়া বলিল – বৎস তোমার জন্য আমরা এক মহাদুঃখে পতিত হইইয়াছি । তোমাকে আমরা আর বরণ পোষণ করিতে পারিব না ।এই নগরে ভিখারিদের অন্নসত্রের ব্যাবস্থা আছে । সেইখানে ভিক্ষা করিয়া তুমি বাচিবার চেষ্টা কর । এই বলিয়া তাঁহাকে পরিত্যাগ করিল। সে এক গৃহ হতে এক গৃহ এইভাবে ঘুরিতে ঘুরিতে আনন্দ শ্রেষ্ঠীর জন্মস্থানে যাইয়া জাতিস্মর হইয়া নিজের গৃহে প্রবেশ করিল। তিনটি দ্বার প্রকোষ্টে কেহই তাঁহাকে দেখিতে পাইল না । ৪র্থ দ্বার প্রকোষ্টে তাঁহাকে দেখিয়া উদ্বিগ্ন হৃদয়ে কাঁদিতে লাগিল। তখন শ্রেষ্ঠীর লোকজনেরা আসিয়া তাঁহাকে দেখিয়া হে কালকর্নী, তুমি দূর হউ । বলিয়া তাঁহাকে প্রহার করিয়া টানিতে টানিতে আবর্জনাস্তূপে ফেলিয়া দিল । বুদ্ধ আনন্দকে লইয়া পিন্ডাচরণ করিতে করিতে সেই স্থানে উপস্থিত হইয়া স্থবিরের দিকে তাকাইয়া জিজ্ঞেস করিলে স্থবির সব বৃত্তান্ত জানাইলেন । স্থবির মুলশ্রীকে ডাকাইলেন । তখন অনেক লোকের সমাগম হইল । বুদ্ধ মুলশ্রীকে ডাকিয়া জিজ্ঞেস করিলেন –

তুমি ইহাকে জান ?

না ভন্তে, জানি না ।

ইনি তোমার পিতা আনন্দ শ্রেষ্ঠী । কিন্তু পুত্র বিশ্বাস করিল না । তখন বুদ্ধ আনন্দ শ্রেষ্ঠীকে বলিলেনআনন্দ শ্রেষ্ঠী, তোমার পঞ্ছনিধি কোথায় আছে পুত্রকে দেখাইয়া দাও । আনন্দ শ্রেষ্ঠী দেখাইয়া দিলে তার পুত্র সব বিশ্বাস করিল । সে তখন বুদ্ধের শরণাগত হইল। তাঁহাকে ধর্মদেশনারচছলে বুদ্ধ এই গাথা বলিলেন

আমার পুত্র আছে,আমার ধন আছে, মূর্খরা এইরূপ চিন্তা করিয়া যন্ত্রণা ভোগ করে ’। যখন নিজেই নিজের নহে, তখন পুত্র কিংবা ধন কিভাবে আপনার হইবে ?

আমার পুত্র আছে, আমার ধন আছে,এইরূপ চিন্তা করিয়া পুত্রতৃষ্ণা এবং ধনতৃষ্ণার দ্বারা মূর্খগ্ণ নিজেদের নষ্ট বিনষ্ট করে, দুঃখ পায় – আমার পুত্রগ্ণ বিনষ্ট হইয়াছে মনে করিয়া কষ্ট পায় , বিনষ্ট হইতেছে মনে করিয়া কষ্ট পায় , বিনষ্ট হইবে মনে করিয়া কষ্ট পায় । ধনের ক্ষেত্রেও ঠিক তদ্রূপ । এইভাবে ছয় প্রকার (অথাৎ তিন প্রকার হইতেছে পুত্রের ক্ষেত্রে আর তিন প্রকার হইতেছে ধনের ক্ষেত্রে ) কষ্ট পায় । পুত্রদের পোষণ করিব বলিয়া দিবারাত্র স্থলজল পথা দিতে নানা প্রকার প্রচেষ্টা চালাইতে যাইয়া কষ্ট পায় । ধন উৎপাদন করিব বলিয়া কৃষি – বাণিজ্য ইত্যাদি করিতে করিতে কষ্ট পায় । এইরূপ দুঃখ প্রাপ্ত ব্যাক্তি নিজেই নিজের নহে এই বিঘাতে দ্বারা দুঃখিত নিজেকে সুখি করিতে অক্ষম ব্যাক্তি জীবিতকালেও নিজেই নিজের নহে মরণ্মঞ্ছে নিপন্ন ব্যাক্তির , মারণাতস্তিক বেদনার দ্বারা অগ্নি জ্বালার দ্বারা পরিদাহ্যমান ব্যাক্তির যাহার (দেহের ) সন্ধিবন্ধনাদি ছিন্ন হইতেছে , যাহার অস্তিসংঘাট ভিন্ন হইতেছে , চক্ষু নিমীলিত করিয়া পরলোকে,চক্ষু উম্মীলিত করিয়া ইহলোক দর্শনকারীর , দিবসে দিবসে দুইবার স্নান করাইয়া , তিনবার ভোজন করাইয়া গন্ধমালাদির দ্বারা অলঙ্কৃত করিয়া যাবজ্জীবন পোষিত হইয়াও সহায়ভাবে দুঃখ পরিত্রাণ

করিতে অসমর্থতার জন্য ‘নিজেই নিজের নহে ’। পুত্র কিংবা ধন কিরুপে আপনার হইবে অথাৎ পুত্র কিংবা ধন সেই সময়ে কি করিবে, আনন্দশ্রেষ্ঠীও কাহাকেও কিছুই না দিয়া পুত্রের জন্য ধন রাখিয়া পূর্বেই মরণমঞ্চে নিপন্ন হইয়াছিলেন। এখন যে এই দুঃখ ভোগ করিতেছেন – তাহার কেহ বা পুত্র, কেহ বা ধন। পুত্রগ্ণ বা ধন সেই সময়ে কি দুঃখ দূর করিয়াছে ? কি সুখই বা উৎপন্ন করিয়াছে ?

দেশনাবসানে চতুরশীতি সহস্র প্রানীয় ধর্মাভিসময় হইয়াছিল । দেশনা জনগণের নিকট সার্থক হইয়াছিল ।

 

 

   

    Founder and Editor : Engr. Anik Barua

            ka-95/5,Noddha,Gulsan,Dhaka1212.                                                                                      Mobile :  +8801845839031 /  +8801407666587        

 

           

   

 

Social Media

error: Content is protected !!