কারণ, হেতু, প্রত্যয় ও নিদান
৩রা অক্টোবর ১৯৯৬ ইংরেজী বৃহস্পতিবার। ভোর ৫ টায় তাঁর শিষ্যদেরকে ধর্মদেশনা দিচ্ছিলেন। প্রথমেই তিনি কারণ, হেতু, প্রত্যয় ও নিদান সম্বন্ধে বলেন- বৌদ্ধ ধর্মে কিছু লইতে দেয় না, খাইতে দেয় না এবং কোন কিছু গ্রহণ করতে দেয় না। যদি অতি প্রয়োজন হয় অনাসক্তভাবে লইতে হয়, খাইতে হয় এবং কোন কিছু গ্রহণ করতে হয়। কারণ, হেতু, প্রত্যয় ও নিদান সম্বন্ধে না জানলে, না বুঝলে বৌদ্ধ ধর্ম সম্বন্ধে কিছুই জানবে না। বৌদ্ধ ধর্ম তিন প্রকারে শ্রেষ্ঠ। যেমন মার্গ, ফল ও নির্বাণে শ্রেষ্ঠ। শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করতে হলে টাকা, পয়সা, সোনা, রূপা, ধন, সম্পদ প্রভৃতি গ্রহণ করতে পারবে না। মার্গ, ফল ও নির্বাণ অজ্ঞানে বুঝতে পারে না।
তিনি একটি উপমা দিয়ে বলেন- দুইশত হাত পানিতে মাত্র আট হাত লম্বা বাঁশ দিয়ে ঠাঁই চাইলে ঠাঁই পাবে? কোন দিন পাবে না। সেরকম যারা বনবিহারে শ্রামণ ও ভিক্ষু হয়, তাদের মধ্যে কিছু সংখ্যক শ্রামণ ভিক্ষু কাপড় ছেড়ে চলে যায়। কেন যায় জান? দুইশত হাত পানিতে আট হাত লম্বা বাঁশ দিয়ে ঠাঁই পাচ্ছে না বলে। এখানে নির্বাণ হল দুইশত হাত পানি এবং তাদের জ্ঞান হল মাত্র আট হাত লম্বা বাঁশ। তলদেশ কোথায় তারা জানে না।
শ্রদ্ধেয় বনভান্তে বলেন- প্রতীত্য সমুৎপাদ নীতি যে বুঝতে পেরেছে সে তলদেশের নাগাল পেয়েছে। এবং বৌদ্ধধর্মে প্রতিষ্ঠিত রয়েছে। সুতরাং সুখও পেয়েছে। তাহলে বুঝা যাচ্ছে নির্বাণ খুব গভীর। তোমাদের চারি আর্য্যসত্য জ্ঞান ও প্রতীত্য সমুৎপাদ নীতি জ্ঞান অর্জন হলে বুঝতে হবে তলদেশ পেয়েছ। না পেলে দুঃখ অবশ্যম্ভাবী। মার্গ, ফল ও নির্বাণ তথা তলদেশ চর্মচক্ষে দেখা যায় না। তা জ্ঞান দ্বারা না জানলে জানা যায় না। জ্ঞান দ্বারা দর্শন না হলে বুঝা যায় না, দর্শন করা যায় না, পরিচয় হয় না এবং চিনা যায় না।
ভগবান বুদ্ধ বলেন- নির্বাণে যাও। অন্য জন বলে আমি যাব না। তাহলে কে বুঝেনি? সেরূপ বনভান্তে বলেন- তোমরা নির্বাণে যাও। তোমরা যদি বল আমরা নির্বাণে যাব না। এখানে কে বুঝেছে এবং কে বুঝেনি? বুদ্ধের কথা ধরলে অনাথ আশ্রম করবে না। সত্যের আশ্রম করবে। অজ্ঞানীরা কাম ভোগ করে এবং জ্ঞানী হলে কাম ভোগ করে না।
তিনি বলেন- বুদ্ধের আমলে বুদ্ধ মূর্তি, ধর্ম, বই ও মাইক ছিল না। বুদ্ধ মূর্তিকে ছোয়াইং দেয় কেন? ভগবান বুদ্ধ না থাকলেও তাঁর ধাতু অস্থি গুলি এখনও আছে। এখানে বুদ্ধ মূর্তিকে ছোয়াইং দেয়া হচ্ছে না। জ্ঞানকে দেয়া হচ্ছে। বুদ্ধ মূর্তি হল জ্ঞানের প্রতীক মাত্র। বুদ্ধ না থাকলেও তাঁর বাণীগুলো এখনও আছে। সকলের সুবিধার্থে বই আকারে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। দূরবর্তী লোকদের শোনার সুবিধার্থে, মাইকের ব্যবহার হচ্ছে।
শ্রদ্ধেয় বনভান্তে বলেন- এ দেহ থাকতে জন্ম, জরা, মরণাদি ধ্বংস করতে না পারলে মরণের পর বার বার জন্মগ্রহণ ও মৃত্যু বরণ করে অশেষ দুঃখ ভোগ করতে হয়। নির্বাণ হলে পুনরায় দুঃখ ভোগ করতে হয় না। নির্বাণ হলে দুঃখ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। অজ্ঞানীরা বলে থাকে মরে গেলে দুঃখ থেকে মুক্তি পেয়েছে। তা নিতান্তই ভুল। কিন্তু একমাত্র যার চিত্ত নিরোধ ও গতি নিরোধ হয়েছে সে শুধু মুক্তি পেয়ে থাকে। চিত্ত উৎপন্ন ও গতি উৎপন্ন হলে পঞ্চ অবস্থা প্রাপ্ত হয়। যেমন মানুষ, দেবতা, প্রেত, নরক ও তির্যক এ পঞ্চ গতিতে গমনাগমন হয়। অজ্ঞানীরা যাবতীয় দুঃখ পেয়ে মৃত্যু হলে উত্তম বলে মনে করে এবং বলে থাকে যে মরেছে সে দুঃখ থেকে মুক্ত হয়েছে। যাঁরা জ্ঞানী তাদের জন্ম মৃত্যু নেই। সুতরাং তাদের কোন দুঃখও নেই।
তিনি আরো বলেন- আনাপান স্মৃতি দ্বারা নির্বাণ লাভ করা যায়। তবে অজ্ঞানীরা শ্বাস-প্রশ্বাস টানলে ও ফেললে তাতে জ্ঞান নেই বলে তাদের জন্ম মৃত্যু হচ্ছে, নির্বাণ লাভ হচ্ছে না। যাঁরা জ্ঞানী তাঁরা শ্বাস গ্রহণ করলে জ্ঞান যোগে গ্রহণ করে এবং নিশ্বাস ফেললে জ্ঞান যোগে ফেলে। আর যারা অজ্ঞানী তারা শ্বাস গ্রহণ করলে অজ্ঞানে গ্রহণ করে এবং নিশ্বাস ফেললে অজ্ঞানে ফেলে।
শ্রদ্ধেয় বনভান্তে বলেন– যারা কাপড় ছেড়ে চলে যায়, তারা কি বুঝে চলে যায়? না বুঝে চলে যায়। উপবাস থাকলে বাবুর্চি বা স্ত্রীর প্রয়োজন হয় না। বনভান্তেও বহুবার উপবাস ছিলেন। তাঁর কোন দিন বাবুর্চি বা স্ত্রীর প্রয়োজন হয় নি। ভিক্ষুর পক্ষে স্ত্রী লোক গ্রহণ করা তো দূরের কথা, ছুঁইলেই পাপ হয়। একবার ডাঃ অরবিন্দ ভিক্ষু হওয়ার আশা করেছিল। তার স্ত্রী তাকে অনুমতি দিয়েছিল। কিন্তু সে ভিক্ষু হয় নি। তাহলে দেখা যাচ্ছে তার ততটুকু সাহস ও জ্ঞান নেই (এ কথাটি বলার পর সবাই হেঁসে উঠলেন)। তিনি বলেন- একবার দেবদত্ত ভগবান বুদ্ধকে বলেছিল- আমি ভিক্ষু সংঘ পরিচালনা করব। বুদ্ধ বললেন- আগে নিজেকে নিজে পরিচালিত কর, পরে অন্যজনকে পরিচালিত করতে পারবে। নিজে মুক্ত হয়ে অপরকে মুক্ত করতে পারে। ঠিক সেরকম নিজে সুপরিচালিত হলে অপরকে পরিচালিত করতে পারে।
বিনা মূল্যে নির্বাণ সুখ পাওয়া যায়। অন্যান্য জিনিস মূল্য দিয়ে কিনতে হয়। কিন্তু নির্বাণ বিনামূল্যে। তাঁর জন্য প্রয়োজন কঠোর পরিশ্রম, অধ্যবসায় ও আকাঙ্খা। কি পরিশ্রম? শীল পরিশ্রম, সমাধি পরিশ্রম ও প্রজ্ঞা পরিশ্রম। কি অধ্যবসায়? শীল, সমাধি ও প্রজ্ঞা অধ্যবসায়। কি আকাঙ্খা? শীল, সমাধি ও প্রজ্ঞা আকাঙ্খা। তাতেই তোমরা পরম সুখ নির্বাণ প্রত্যক্ষ করতে পারবে। বনবিহারেও কোন কিছু মূল্য দিতে হয় না। তবে নির্বাণ প্রত্যক্ষ করতে হবে। বৌদ্ধ ধর্মে বলতে হয় সকল সংস্কার অনিত্য, সকল সংস্কার দুঃখ ও সকল সংস্কার অনাত্ম। অনিত্য অর্থাৎ ক্ষয় ব্যয়শীল, দুঃখ অর্থাৎ যাহা অহরহ নিষ্পেষিত হচ্ছে এবং অনাত্ম- যাহা অনিচ্ছাবশে সংগঠিত হয়, আপনার নহে বলে। ত্রিপিটককে বিস্তারিত করলে চারি আর্য্যসত্য বুঝায়। চারি আর্য্যসত্যকে বিস্তারিত করলে আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ বুঝায়। অষ্টাঙ্গিক মার্গকে বিস্তারিত করলে ৩৭ প্রকার বোধি পক্ষীয় ধর্ম বুঝায়। ৩৭ প্রকার বোধি পক্ষীয় ধর্মকে বিস্তারিত করলে চুরাশি হাজার ধর্মস্কন্ধ বুঝায়। ভগবান বুদ্ধ প্রথমে সংক্ষিপ্ত দেশনা করেন। পরিশেষে বিস্তারিত ভাবে দেশনা করেন।
পরিশেষে শ্রদ্ধেয় বনভান্তে দুই লাইন বিশিষ্ট গাথা বলে তাঁর দেশনা সমাপ্তি ঘোষণা করেন।
সুবিচারে সবিনয়ে চালায় অন্যজন।
ধর্মস্থ মেধাবী নামে অভিহিত হন।।